নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি। জরুরি রক্তের প্রয়োজন। বেসরকারি চাকরিজীবী মুখলেছুর রহমান খোঁজ পান রেশমা বেগমের। তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী ডোনার ক্লাব পরিচালনা করেন।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টা। রেশমার খোঁজে বরিশাল নগরীর কেডিসি কলোনিতে ঢুকতে গেলে গলির মুখেই চার নারীসহ কয়েকজন মুখলেছুরকে আটকে দেন। জেরায় তাঁর ত্রাহিদশা। বেশি প্রশ্ন করা হয় মাদক নিয়ে। পরে প্রহরীরা রেশমাকে ফোন করে আনার পর হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন মুখলেছুর। ডোনারকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে ফেরেন তিনি।
রেশমা বেগম বলেন, অপরিচিত কেউ কলোনিতে এলে নাম-পরিচয়, কার কাছে এসেছেন, আসার কারণ– এসব নিশ্চত হয়ে কলোনিতে ঢোকার সুযোগ পান। আবার যাওয়ার সময় সন্দেহ হলে শরীর তল্লাশিও করা হয়। দুটি প্রবেশ পথে একই নিয়ম।
কীর্তনখোলা নদীতীরের বিশাল এলাকা কেডিসি কলোনি বা বালুর মাঠ বস্তি। ৫ দশমিক ৮৬ একরের বস্তিটি ‘মাদকের হাট’ নামে পরিচিত। এখানে ৭৪৫ পরিবারে ১০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। গত ঈদুল আজহার পর গঠন করা মাদক নির্মূল কমিটির ভূমিকায় বদলাতে শুরু করেছে কলোনির চিত্র। সেখানে নারীদের লড়াই বিশেষ নজর কাড়ছে।
৫১ সদস্যের কমিটির ৩২ নারী পাহারা থেকে সচেতনতা তৈরিতে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। ব্লাড ডোনার ক্লাবের পাশাপাশি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রেশমা বেগম নিজেই মাদক কারবারি খালাতো ভাই রুবেল মিয়াকে পুলিশে দিয়েছেন। তাঁর মতো কলোনির নানা বয়সী নারী মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের শামিল করেছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সরু গলিতে গায়ে গা লাগানো বসতঘর। বাসিন্দাদের বেশির ভাগ রিকশা-ইজিবাইকচালক, ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও দিনমজুর। পাঁচ বছর আগে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন কলোনির বাসিন্দা মাদক কারবারি আবদুল মালেক। স্বামীর মৃত্যুর পর কারবার চালান নিলুফা বেগম।
বর্তমান কমিটির উদ্যোগে তিনিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। নিলুফা বেগম বলেন, ‘কেউ কাজ দেয়নি। একমাত্র সন্তান নিয়ে অভাবে পড়ে ইয়াবা বিক্রিতে নামি। তবে নির্মূল কমিটির উদ্যোগে সব ছেড়ে দিয়েছি। কাজও পেয়েছি। ভয়ানক এ পথে আর পা বাড়াব না।’
যেভাবে কমিটির যাত্রা,কলোনির প্রথম গলির মুখে ফারুক হাওলাদারের চা দোকান। তিনি জানান, কোরবানি ঈদের আগে জেলা প্রশাসকের দপ্তরের একজন কলোনিতে এসে ঘোষণা দেন– নিয়ন্ত্রণহীন মাদক কারবারের কারণে কেডিসি কলোনির সব বাসিন্দাকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে জেলা প্রশাসকের সভায়। গুটিকয়েক মাদক কারবারির জন্য শত শত পরিবার উচ্ছেদ হবে– বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। শুরু হয় মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই।
ঈদের পরপরই ‘মাদক নির্মূল কমিটি’ গঠন হয়। কমিটির সদস্য সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, অনেকবার কমিটি করেছি; শেষ সময়ে সবাই নিজেকে গুটিয়ে নেন। এবার আমরা ১২ জন মসজিদে ঢুকে শপথ নিই– মাদকের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই করব। এর পর তৎপরতা শুরু করি। দেড় মাসের মাথায় কলোনির প্রায় সবাই আমাদের সঙ্গী। কমিটির নারীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পাহারা থেকে প্রশাসনের দ্বারস্থ, উঠান বৈঠক– সবখানে তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) বরিশালের উপপরিচালক তানভির হোসেন খান বলেন, বছরখানেক বরিশালের আইনশৃঙ্খলা কমিটিসহ বিভিন্ন সভায় কেডিসি কলোনির মাদক কারবার নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়। মাত্র ৩০ পরিবারের কাছে সবাই জিম্মি। দুই মাস আগে স্থানীয়রা সহযোগিতা চাইলে আমরা তাদের নিয়ে সভা করি। ক্রেতা-বিক্রেতা ও সেবনকারী মিলে দুই মাসে অন্তত ৮০ জনকে আটক করি। এখন কলোনিতে মাদকের উপদ্রব ৮০ ভাগ কমে গেছে।
স্বেচ্ছাশ্রমে ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম
হুমায়ুন কবির জানান, রাত ১২টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত ১০ জন কলোনিতে হুইসেল বাজিয়ে টহল দেন। সকাল ৭টা থেকে বেলা ৩টা এবং ৩টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ছয়জন করে দুটি প্রবেশপথ পাহারা দেন। প্রতিটি গ্রুপে চারজন নারী থাকেন। তবে রাতে নারীরা বাইরে থাকেন না। সন্দেহজনক কোনো নারীকে তল্লাশির প্রয়োজন পড়লে তাদের ডেকে আনা হয়। বাইরের আগত কেউ উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে পুলিশের হাতে দেওয়া হয়।
প্রথম প্রবেশমুখে লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছেন আলেয়া বেগম (৬৫)। গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। আলেয়া জানান, মেজো ছেলে বজলুর রহমানের গাঁজায় আসক্তি তাঁকে ভীষণ নাড়া দেয়। কোনো মতে তাকে এ পথ থেকে ফেরাতে পেরেছেন। অন্য মায়েদের সর্বনাশ ঠেকাতে তিনি লড়াইয়ে নেমেছেন বলে জানান। সংসার কীভাবে চলছে– এই প্রশ্নে আলেয়া বলেন, ‘সন্তানরা রোজগার করছে। আল্লাহ ভালো রেখেছেন।’
কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাইদুল ইসলাম সাকিব ছাত্র ফেডারেশনের জেলা সাধারণ সম্পাদক। আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক রোকসানা নার্গিস গৃহিণী। নার্গিস বললেন, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাত্রপক্ষ কলোনিতে ঢুকলে তাদেরও বলা হতো, ‘নেবেন’, ‘লাগবে’। তাই অনেক মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব শুরুতেই ভেস্তে গেছে। মাদকাসক্ত সন্তানের অত্যাচার সইতে না পেরে মায়েরা কিছু করার আকুতি জানিয়েছেন। একা কিছু করা সম্ভব হয়নি। সবার চেষ্টায় এখন কলোনি বদলে গেছে। পরিবারের সহায়তায় সম্প্রতি মাদকাসক্ত রায়হান (২৫) ও রাকিবকে (২০) পুলিশে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাকিব জানান, তাদের কঠোর অবস্থানের কারণে অনেকেই এসে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি জানাচ্ছেন। প্রথমে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। পরিবর্তন হলে তাকে স্বাগত জানিয়ে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। কারও বোধোদয় না হলে, তাকে পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে দেওয়া হচ্ছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কমিটিকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করছি।
সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ ৮৬