• ১৩ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বরিশাল বানারীপাড়ার ভাসমান ধান-চালের হাট জৌলুস হারিয়েছে

"আলোকিত সংবাদ ডেস্ক"
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫, ২২:০০ অপরাহ্ণ
বরিশাল বানারীপাড়ার ভাসমান ধান-চালের হাট জৌলুস হারিয়েছে
সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বসে ঐতিহ্যবাহী ভাসমান ধান-চালের হাট। এক সময় এটি দেশের সর্ববৃহৎ চালের বাজার ছিল। তবে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা এবং অটোরাইস মিলের কারণে হাটটির জৌলুস হারিয়েছে। তবুও দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে এটি এখনো গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় হাটটির ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব।

স্থানীয়রা জানান, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে গড়ে ওঠে এই ধান-চালের ভাসমান হাট। বালাম চালের সুখ্যাতি থাকায় ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার শত শত ফড়িয়া এখানে এসে চাল ক্রয়-বিক্রয় করতেন। এ ছাড়া পটুয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ভোলাসহ অন্যান্য জায়গার ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে বানারীপাড়ায় আসতেন।

বানারীপাড়া উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও সংগঠক মোয়াজ্জেম হোসেন মানিক বলেন, এক সময় অনুন্নত সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার কারণে স্থানীয় লোকজন নৌপথে চলাচল ও পণ্য পরিবহন করতেন। নৌকায় করে কৃষক হাটে কৃষিপণ্য নিয়ে যেতেন। ক্রেতারা তা কিনে নৌকায় করে নিয়ে যেতেন। নৌকায় বসে কেনাবেচা করতে করতে ভাসমান হাটের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে হাটের ব্যাপ্তি বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, ‘বাপ-দাদার মুখে শুনেছি এই হাটে এত বেশি নৌকা আসত, নদীর এপার থেকে ওপারে এক নৌকা থেকে অন্য নৌকা- এভাবে হেঁটে নদী পার হওয়া যেত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধান-চাল বেচাকেনায় ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসায়ীরা। তবে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা, অটোরাইস মিলের ব্যাপক সংখ্যা ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাল উৎপাদনসহ নানা কারণে এই বাজারের জৌলুস হারিয়েছে।’

স্থানীয় মিজানুল ইসলাম বলেন, ’৮০ দশকের পর থেকে বরিশালের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বাগেরহাটসহ দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সড়কপথের বিস্তৃতি ঘটেছে। বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা এখন হাট-বাজার থেকে ধান-চাল কিনে সরাসরি ট্রাকের মাধ্যমে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছেন। এতে বাজারটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তবে এখনো হাটটির গুরুত্ব রয়েছে।’

ষাটোর্ধ্ব ধান-চাল ব্যবসায়ী শাহজাহান সর্দার বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি, ছোট-বড় হাজার হাজার নৌকা ও কার্গো-লঞ্চযোগে মানুষ এখান থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যেত। নদীর প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই হাট বসত। তবে এখন আগের মতো নৌকা আসে না।’

স্থানীয় বাসিন্দা এনায়েত হোসেন মোল্লা বলেন, ‘দক্ষিণের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কিনে এনে এই হাটে বিক্রি করা হতো। কুটিয়ালরা ধান কেটে চাল তৈরি করে আবার এই হাটেই বিক্রি করত। তবে এখন আর আগের মতো হাজার হাজার নৌকা আসে না।’

সাবেক ইউপি সদস্য ও পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল হাই বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে অটোরাইস মিল গড়ে ওঠায় কুটিয়ালের সংখ্যা কমে গেছে। তার পরও এ অঞ্চলের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে এটি পরিচিত। এপার-ওপার মিলে প্রতি হাটে ছোট-বড় হাজারখানেক নৌকা ও ট্রাক ধান-চাল নিয়ে আসে।’

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ‘বানারীপাড়ার ধান-চালের ভাসমান হাট দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যের একটি অংশ। বিশেষ করে নদী এলাকার ব্যবসা ও বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু এটি। বিভিন্ন কারণে হাটটি আগের মতো জমজমাট না থাকলেও এখনো এর গুরুত্ব রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নদী-অর্থনীতি ও নদীকেন্দ্রিক ব্যবসার প্রসারে বানারীপাড়ার হাটটি উদাহরণ হতে পারে। কারণ এ হাটের সঙ্গে যুক্ত কৃষক, ভোক্তা, পাইকার ও কুটিয়াল। এই হাটকে প্রসারিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।’