বরিশাল নগরীর সৈয়দ ব্রাদার্স সব আমলেই বেপরোয়া
আলোকিত সংবাদ ডেস্ক::একই পরিবারে পাঁচ ভাই। এক ভাই বিএনপি সরকারের আমলে ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর। পরে আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর হন আরেক ভাই। সরকারের পালাবদলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ভাই বদল হলেও কোনো পরিবর্তন নেই তাদের দখল-চাঁদাবাজির।সব সরকারের আমলেই সুবিধাভোগী তারা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনে আবার প্রভাবশালী হন বিএনপির আমলের কাউন্সিলর ভাই। এরই মধ্যে তারা নেমে পড়েছেন দখলে।
ভুয়া ডিক্রি দিয়ে জমি দখলে নিজ ভিটা থেকে উচ্ছেদ চেষ্টা করেছেন অসহায় সংখ্যালঘু বৃদ্ধাকে। এ ছাড়া বিচার-সালিশির নামে বহু মানুষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান, জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে এ পরিবারের বিরুদ্ধে।
বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলে আরও বেপরোয়া।
তারা হলেন বরিশালের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাঠপট্টি এলাকার মৃত সৈয়দ চুন্নু মিয়ার পাঁচ সন্তান। দখলের অভিযোগ রয়েছে চুন্নু মিয়ার বিরুদ্ধেও। এর মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ জামাল হোসেন নোমান বিএনপি ও সৈয়দ হুমায়ুন কবির লিংকু আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
জানা যায়, বিএনপির সমর্থন নিয়ে ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন জামাল হোসেন নোমান। এরপর ২০১৩ সাল পর্যন্ত টানা কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। একসময় বিএনপি করলেও আর এক ভাই সৈয়দ হুমায়ুন কবির লিংকু ক্ষমতার পালাবদলে যোগ দেন আওয়ামী রাজনীতিতে। এরপর লিংকুর ছত্রছায়ায় চলে নানা অপকর্ম।
পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন লিংকু। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ফের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন বিএনপি আমলের কাউন্সিলর জামাল হোসেন নোমান। এখন নোমানের নেতৃত্বে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ সৈয়দ পরিবার।
জানা যায়, ২০২২ সালে ৭৫ বছর বয়সী মালতী রাণী নাথ নামে এক নারীর ৫ কোটি টাকার মূল্যের জমির দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে নেওয়া হয়।
এরপর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট সেই জমির বাকি অংশ দখলে হামলা হয় জামাল হোসেন নোমানের নেতৃত্বে। সেখানে থাকা দেবনাথ বস্ত্রালয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয় মালপত্র। লুটে নেওয়া হয় টাকা।
মালতী রাণীর নাতি শুভ দেবনাথ বলেন, ২০১৩ সাল থেকে একটি ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে তারা আমাদের জমি দখলে অন্তত ৮ থেকে ১০ বার হামলা চালিয়েছে। সবশেষ ৬ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে হামলা চালিয়ে দোকানে ভাঙচুর করা হয়। ভেতরে থাকা ৪ লাখ টাকার মালপত্র ও দেড় লাখ টাকা লুটে নিয়ে যায় তারা। এ ঘটনায় মালতী রাণী নাথের নাতি দেবাশীষ দেবনাথ বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করলে জামাল হোসেন নোমানকে গ্রেপ্তারের পর জেলহাজতে প্রেরণ করেন আদালত।
জানা যায়, সুনীল কুমার সাহা নামে এক ব্যক্তি একটি ভুয়া ডিক্রি বানিয়ে মালতী রাণীর জমির মালিকানা দাবি করেন। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। মামলা চলমান থাকায় একটি আমমোক্তারনামার বলে জামাল হোসেন নোমান তার ছোট ভাই সেয়দ কামাল হোসেন রুবেলের নামে জমিটি লিখে দেন। নথিপত্র বলছে, যেই ডিক্রির জোরে সুনীল কুমার সাহা জমিটির মালিকানা দাবি করছেন, সেই ডিগ্রিটি নেওয়া হয়েছে ১৩৫০ সনের ১৫ বৈশাখ, যা ইংরেজি ১৯৪৩ সালের ২৮ এপ্রিল। অন্যদিকে এনআইডি এবং জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী সুনীল কুমারের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই। অর্থাৎ সুনীল কুমারের যেই ডিক্রির বদৌলতে জামাল হোসেন নোমান জমিটির মালিকানা দাবি করছেন, সেই সময়ে সুনীল কুমারের জন্মই হয়নি।
আর ওই আমমোক্তারনামা নেওয়ার পর থেকে সুনীল কুমারের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। জানা যায়, কয়েক বছর আগে তিনি ভারতে মারা গেছেন।
এ ছাড়া স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এ পরিবারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, জমি দখল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেওয়াসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা জানান, বরিশালের চকবাজারে নজিব মৃধার দোকানের সামনে সেলাই মেশিন নিয়ে দর্জির কাজ করতেন সৈয়দ চুন্নু মিয়া আর রাতে করতেন নৈশপ্রহরীর কাজ। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ ক্লথ স্টোর্স। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সৈয়দ পরিবারকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি ও সম্পত্তি দখল করে অঢেল সম্পদ গড়ে চুন্নু মিয়ার পরিবার। বাবার দেখানো পথেই হিন্দু এবং সরকারি জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ছেলে জামাল হোসেন নোমান ও হুমায়ুন কবির লিংকু।
জানা গেছে, চকবাজারের বিহারি বস্ত্রালয়ের মালিক ছিলেন প্রবীর সাহা। ২০১০ সালের দিকে তার সেই প্রতিষ্ঠান দখল নেন সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর জামাল হোসেন নোমান ও সদ্য সাবেক কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির লিংকু। সেই বিহারি বস্ত্রালয়ের নাম পরিবর্তন করে এখন জুনায়েদ ব্রাদার্স নামে পরিচালনা করছেন তারা।
একই এলাকার লক্ষ্মী সাহার মালিকানাধীন ভবন দখল করে সেখানে সৈয়দ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স প্রতিষ্ঠা করেছে নোমান ও লিংকুর পরিবার। বাসেদ মিয়ার মালিকানাধীন বাসেদ প্রেসও দখলে নিয়েছেন তারা। স্থানীয়রা জানান, বাসেদ মিয়ার সঙ্গে তার ভাইদের বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের মীমাংসা করতে গিয়ে সালিশির নামে নোমান নিজেই দখল করে নেন বিরোধপূর্ণ সম্পত্তি। এ ছাড়া কাঠপট্টিতে সরকারি খাস খতিয়ানের জমি দখল করে প্রতিষ্ঠা করেছেন রেমন্ড টেইলার্স, একই এলাকার তরুণ জুয়েলার্সের মালিক তরুণ সাহার সঙ্গে বিরোধ চলছিল পার্শ্ববর্তী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। সেই দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে তরুণ জুয়েলার্স দখলে নেন নোমান ও লিংকু।
অনুসন্ধানে এই পরিবারের শত শত কোটির টাকার সম্পদের সন্ধান মিলেছে। যার মধ্যে রয়েছে বরিশালের কাঠপট্টিতে সরকারি খাস জমিতে জুম্মান ব্রাদার্স, যার বাজার মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় সরকারি জমিতে নিউ সৈয়দ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, যার বাজার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। সরকারি খাস জমিতে বিহারি বস্ত্রালয় যার বর্তমান নাম জুনায়েদ ব্রাদার্স, বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। কাঠপট্টি সৈয়দ প্লাজা, যার বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। কাঠপট্টিতে সৈয়দ ক্লথ স্টোর, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। যে বাড়িতে বসবাস করেন, সেটির নাম সৈয়দ মঞ্জিল, যার বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। কাঠপট্টিতেই তরুণ জুয়েলার্স, যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা।
এ ছাড়া রয়েছে বাসেদ প্রেস, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৩ কোটি টাকা। কাঠপট্টি পূজামণ্ডপের সামনে আরও একটি বাড়ি রয়েছে, যার মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। কাঠপট্টিতে রেমন্ডের একটি শোরুম, যার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রয়েছে কয়েকটি ফ্ল্যাট, ইসলামপুরে কাপড়ের দোকান, চকবাজারের বাটার সামনে সংখ্যালঘুদের দখল করা প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি, কাঠপট্টির মেথরপট্টিতে আরও একটি বাড়ি, রূপাতলীতে জমি, আশুলিয়ায় জমি রয়েছে বলে জানা গেছে। চলাফেরার জন্য রয়েছে অন্তত চারটি গাড়ি। এ ছাড়া বরিশাল সিটি করপোরেশনে সৈয়দ পরিবারের আরও কিছু সম্পত্তি রয়েছে। যার হোল্ডিং নম্বর ১০১, ১০২, ১০৬, ১১৫, ১১৬, ৩১৬, ২৭০, ২৭২, ২৭৩, ৬৯৭।
জেলহাজতে থাকায় জামাল হোসেন নোমানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার ছোট ভাই হুমায়ুন কবির লিংকু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে কাউন্সিলর হলেও আমি বিএনপি করি। বিএনপি থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এরপর আমি নির্বাচন করেছি।’
উল্লিখিত সম্পদ থাকার কথা স্বীকার করলেও দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে লিংকু দাবি করেন, এসব সম্পত্তি তারা কাপড়ের ব্যবসা করে গড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। প্রশ্নের জবাবে লিংকু প্রথমে বলেন, তার বাবা ইসলামপুরে ছোটখাটো কাপড়ের ব্যবসা করতেন। কখনো নৈশপ্রহরীর চাকরি করেননি। কাপড়ের ব্যবসা করেই এসব সম্পদ গড়েছেন। এসব সম্পদ ১৯৯০ সালের দিকে কেনা। ছোটখাটো কাপড়ের ব্যবসা করে এত সম্পদ কীভাবে গড়লেন—এমন প্রশ্নে বলেন, এগুলো ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ সম্পত্তি। ব্যাংকের কাছে কবে বন্ধক রেখেছেন জানতে চাইলে আবার বলেন, ২০০৯ ও ২০১০ সালের দিকে। শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পরেরদিন ৬ আগস্ট জমি দখলের উদ্দেশ্যে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ওটা তার ভাইয়ের ভুল ছিল।
সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ ৪৩০