নিজস্ব প্রতিবেদক ::: পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) পৌরসভায় সেবক হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটি নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের প্রায় ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে জনস্বার্থে কাজ করার কথা থাকলেও নিয়ম অমান্য করে সঞ্চয় ও ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এদিকে আমানতের টাকা তুলতে গিয়ে হয়রাণির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। ক্ষমতার দাপটে বিভিন্ন সময় গ্রাহকদের হয়রাণি ও জেল খাটানোর অভিযোগ রয়েছে সেবক হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটির পরিচালক বাবু কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে।
উপজেলা সমবায় অফিস ও সমিতির গ্রাহক সূত্রে জানা যায়, সেবক হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটি একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। যার নিবন্ধন নম্বর ১৮৬০। এটি বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের নিবন্ধিত। এটি একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। যেখানে জনস্বার্থে কাজ করার কথা উল্লেখ রয়েছে। যা সঞ্চয় ও ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনার এখতিয়ার নেই। প্রথম থেকেই তারা প্রতারণার মাধ্যমে লোভনীয় লভ্যাংশের আশ্বাস দিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের আমানত আদায় করেন।
সূত্রে আরও জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে মাসিক আমানত জামানতকারী গ্রাহকের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এদের আমানতের মোট পরিমান প্রায় ১৩ কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালু থাকলেও গত কয়েক মাস ধরে গ্রাহকদের মুনাফা ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সম্প্রতি গ্রাহকরা লভ্যাংশসহ আমানতের টাকা চাইতে গেলে তাদেরকে নানাভাবে হয়রাণি ও জেল খাটানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বাবু কৃষ্ণ দাস প্রশাসনের কর্তাবাবুদের ম্যানেজ করে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে গ্রাহকের দাবিয়ে রাখেন অভিযোগ একাধিক গ্রাহকের। এমনকি কোন গ্রাহক আমানতের টাকা চাইতে গেলে তাকে বলেন- টাকা থানার ওসির কাছে রাখা আছে, সেখান থেকে নিয়ে নিতে।
গ্রাহকদের অভিযোগ- বাবু কৃষ্ণ দাস ছিলেন একজন বড়ই বিক্রেতা। হঠাৎ তিনি হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। সকলকে জানান তিনি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি চালু করেছেন। এরপর তিনি লোভনীয় লভ্যাংশের আশ্বাস দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে জামানত আদায় করা শুরু করেন। আস্তে আস্তে তার সমিতি পরিধি বাড়তে থাকে। এখান থেকেই তার জীবনের উত্থান শুরু হয়। মানুষের আমানতের অর্থের পরিমান বাড়ায় তার সমিতি ভারী হতে থাকে। এরপর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বাবু কৃষ্ণ দাস। নাম লেখান রাজনীতিতে। স্বরূপকাঠি পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের যুবদলের সহ-সভাতি পদ পান তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তখন বিএনপি ক্ষমতায় নেই। সুবিধা করতে না পেরে তিনি ভুলে যান তার জাতীয়বাদী যুবদলের কথা। কতিপয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে হাত করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষের অর্থ এফডিআর রাখেন। পাশাপাশি সমিতির টাকা দিয়ে সম্পত্তি ক্রয় করেন। এমনকি দুটি মোটর সাইকেলের শো-রুম ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করেন।
তারা আরও জানান- বিগত স্বরূপকাঠি পৌরসভা নির্বাচনে তিনি কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ করেন। কিন্তু তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। তৎকালিন সময় নিজের ক্ষমতার জানান দিতে সাবেক এক ইউএনওকে তার মেয়ের জন্মদিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত রাখতে তার শোরুম থেকে একটি মোটরবাইক উপহার দেন। এদিকে পুলিশকে হাতে রাখতে সাবেক সার্কেল এসপি রিয়াজ হোসেনকে লোভনীয় লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে ৪০ লাখ টাকা সমিতিতে এফডিআর করান। যার বিনিময়ে প্রতি লাখে ৩ হাজার টাকা করে মুনাফা দিতেন। এর বিনিময়ে রিয়াজ হোসেনের ড্রাইভার ফারুককে তার কিস্তির টাকা উঠাবার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দূর্গা পূজার সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্টেজে ওঠার জন্য ৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে তার সমিতির ঋণের কিস্তি আদায় করতে গ্রাহকদের নানা পদ্ধতিতে হয়রাণি ও লাঞ্ছিত করতেন। ৩০০ টাকার কিস্তি বিলম্ব করায় নাজমুল নামের এক অটোচালককে বাবু কৃষ্ণ দাস নিজ হাতে জুতা পিটা করেন। তার ঘনিষ্ঠ নির্বাচনের সহযোদ্ধা নাসিরকেও তিনি ৩ হাজার টাকার জন্য জেল খাটিয়েছেন। তৎকালিন সময় স্বরূপকাঠি পৌরসভা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ২নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সাখাওয়াত হোসেন স্বপনকে এক বছরের বেশি সময় জেল খাটিয়েছেন।
সম্প্রতি গ্রাহকরা জানতে পারেন সেবক হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটি নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এদের সঞ্চয় ও ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনার এখতিয়ার নেই।
বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি আবার যুবদলের রাজনীতিতে সক্রীয় হয়ে উঠেছেন। এখন যুবদলের পরিচয় দিতে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে গ্রাহকদের দাবিয়ে রাখছেন। তিনি এখন গ্রাহকরা আমানতের টাকা ফেরত চাইতে গেলে তাদের সমবায় অফিসার ও প্রশাসনের ভয় দেখান। সমবায় অফিসার এবং প্রশাসন কি বিষয়টি জানে? এমন প্রশ্ন গ্রাহকদের। তিনি বিলাসিতা করে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ব্যয় করেছেন বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।
ওই প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী ও সমিতির একজন জামনতকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি ওই সমিতিতে শুরু থেকেই মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করতাম। বাবু কৃষ্ণ দাসের সমিতিতে অধিক লাভের আশ্বাসে লোকজনকে আমানত রাখার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ করেছি এবং আমি নিজেও ওই সমিতিতে একটি আমানত খুলি। ওই হিসাবে আমার ৪ লাখ টাকা পাওনা আছে। আমানতের টাকা চাইতে গেলে নানা ধরনের ভয়ভিতি ও হুমকি দেয়া হয়। তার অনেক ক্ষমতা, তাই তার ভয়তে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
সমিতির গ্রাহক সমীর আচার্য্য বলেন, প্রতি লাখে মাসিক তিন হাজার টাকা মুনাফার আশ্বাস দেয় বাবু কৃষ্ণ। তার দেওয়া আশ্বাসে আমি ওই সমিতিতে হিসাব খুলি। গত কয়েক মাস ধরে লভ্যাংশসহ জমা দেওয়া টাকা চাইতে গেলে দেব-দিচ্ছি বলে টালবাহানা করতে থাকে। এবং বলেন- তার সময় মতো তিনি টাকা পরিশোধ করবেন।
এ বিষয়ে সেবক হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটির ম্যানেজার পলাশ বলেন- নিয়মিত আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমরা গ্রাহকদের টাকাও নিয়মিত পরিশোধ করছি। আমাদের আরও একটি সমিতি আছে ‘উদয়ের আলো’। এফডিআর মেচুইট হলেই টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। আমি সবটা বলতে পারবো না। আপনি পরিচালক মহোদয়ের সাথে কথা বলুন।
এ বিষয়ে জানতে সেবক হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটির পরিচালক বাবু কৃষ্ণ দাসের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
এ প্রসঙ্গে সদর নেছারাবাদ উপজেলার সমবায় কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসান রকি জানান, সেবক হেলথ্ এন্ড এডুকেশন সোসাইটি নামে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে তাদের সঞ্চয় ও ঋণদানের কোন এখতিয়ার নেই। তারা জনস্বার্থে কাজ করবে। এরপরেও তারা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণা করছেন। এ বিষয়টি নিয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করে গত ১২ মে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছি।
এ বিষয়ে নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন- বিষয়টি আমার জানা নেই। গ্রাহকদের টাকা তাদের অবশ্যই বুঝিয়ে দিতে হবে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ ৮৫