রাহাত রব্বি ::: বরিশাল জেলার দশটি উপজেলায় ইটভাটার রাজ্য। মাত্র ২,৭৮৪.৫২ বর্গকিলোমিটারের দশটি উপজেলায় রয়েছে ২২৫টি ইটভাটা। এর মধ্যে মাত্র ১১৪ বৈধতা রয়েছে। বাকি ১১১টি ইটভাটাগুলো যুগের পর যুগ ধরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠে চলে আসছে।
সরেজমিনে জেলার উপজেলাগুলো ঘুরে দেখা যায়, কৃষি জমিতে ইটখোলা তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তোয়াক্কা করছেন না কেউ। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ নষ্ট করে ও নদ-নদীর তীর গিরি গরে উঠেছে সবই ইটভাটা। ২২৫টি ইটভাটার এক তৃতীয় অংশ ভাটা গুলোতে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধভাবে কাঠ দিয়ে পোড়ানো হয় ইট। মানা হচ্ছে না কোন প্রকার আইন।
পরিবেশ অধিদপ্তর আইন অনুযায়ী, লোকালয় বাজার, বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরে ইটখোলা করার নিয়ম থাকলেও কেউই তা মানছেন না। একের পর এক আইন অমান্য করে গড়ে উঠছে বেশিরভাগ ইট ভাটা। কাঠ দিয়ে পোড়ানো হয় ইট এতে করে সেখানকার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ ও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষিজমি। এতে বাতাস দূষিত হয়ে শ্বাসকষ্ট, চর্ম ও হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। বেশিরভাগ ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছে নবজাতক শিশুরা। এরপরও কোন মাথা ব্যাথা নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের।
প্রশ্ন হচ্ছে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিভাবে ইট তৈরি করছে এসব অবৈধ ভাটাগুলো‚ খোঁজ নিয়ে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়- কিছু সংখ্যক ভাটা বন্ধ থাকলেও বেশির ভাগ ভাটা আইনকে ভঙ্গ করে অবৈধভাবে ইট তৈরি করছে। কয়লার বদলে কাঠ দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে ইট। এসব ইট ভাটার মালিক পক্ষরা পরিবেশ অধিদপ্তর‚ প্রশাসন, থানা পুলিশ, ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মোটা অংকের অর্থের বিনিময় ম্যানেজ করে যুগের পর যুগ চালিয়ে আসছে কার্যক্রম।
ভূমি অফিস ও বরিশাল সদর উপজেলা সূত্রে জানা যায়, বরিশাল সদর উপজেলার ২০৫৮.৪০২ একর জমির মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ : ৫৭৯ একর। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বরিশাল সদর উপজেলার মোট ৫,২৭,০১৭ জনসংখ্যা রয়েছে। ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শীতলক্ষ্যা নদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অবৈধ সব ইটভাটা। সেখানকার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ ও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ১০টি উপজেলায় ২২৫টি ইটভাটা রয়েছে। এসবের মধ্যে মাত্র ১১১টি বৈধতা থাকলেও। আর তালিকার বাইরে আছে আরও অর্থ শতাধিক ভাটা। কোন আইন না মেনেই চলছে ভাটাগুলো।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক ইটখোলা গড়ে উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানান, প্রশাসন, থানা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মোটা অংকের অর্থের বিনিময় ‘ম্যানেজ’ করেই এসব ইটভাটা চালাচ্ছে মালিক পক্ষ। প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও কয়েক দিন পর আবারও ম্যানেজ করে পুনরায় চালু হয়ে যায় ইট খোলাগুলো।
স্থানীয়রা আরো বলেন, একসময় প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন হতো। কিন্তু বর্তমানে ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় এখানকার আবাদি জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণে গাছেও ফল ধরছে না। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য ও কৃষিখাত।
চার কাওয়া ইউনিয়নের এলাকার কৃষক শামীম আহমেদ বলেন, ইটখোলার কারণে আমাগো খেত-খামারে আগের মতন ফলন অয় না। গাছে ফুল ও ফল আহে না। আগে নারিকেল গাছে ডাবের কাঁদি ঝুইলা থাকত। এখন ডাবগুলান ছিট পইড়া যায়গা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উত্তম ভৌমিক বলেন, ইটভাটাগুলোর কারণে সদর উপজেলার ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। আগে ধান উৎপাদন হতো বিঘায় ৩০ মণ। এখন বিঘায় ২০/১৫ মণ উৎপাদন হয়।
কাশিপুর এলাকার স্কুল শিক্ষক আবদুল হালিম বলেন, একসময় ইউনিয়নে বইত নির্মল বাতাস। চারদিকে ছিল সবুজের সমারোহ। এখন যেদিকে চাইবেন ইটভাটা আর ইটভাটা। ধোঁয়া আর ধুলায় একাকার। এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চললে ও এরপর আবার শুরু হয়।
তিনি আরো বলেন, ইটভাটার ধুলা আর ধোঁয়ার কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে হতে পারে। এভাবে চললে ইউনিয়নে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
তবে ইটভাটার মালিকদের বক্তব্য ভিন্ন। তারা বলেন, ইটভাটার কারণে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ কাজ করে খাচ্ছেন। আমরা তো ক্ষতি করছি না। আইন না মেনে কিভাবে চালান এমন প্রশ্নের উত্তর বলেন- আমরা সবার সঙ্গে কথা বলেই ইটভাটা চালাচ্ছি।
বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক কাজী সাইফুদ্দীন বলেন, আমরা অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছি। সামনে অভিযান চলমান থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: ইকবাল হাসানের মুঠোফোনে একাধিকার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেন নি।
একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললে বলেন, প্রশাসন অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করলে পুলিশ সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ ৯৮