নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: মেঘনা নদীতে জাহাজে সাত খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ওই জাহাজের কর্মচারী আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সংস্থাটির দাবি, সবকটি হত্যাকান্ড আকাশই ঘটিয়েছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ জানিয়েছেন, জাহাজের মাস্টারের ওপর থাকা ক্ষোভের কারণে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন তিনি।
সোমবার চাঁদপুরে হাইমচরের মাঝিরচর এলাকায় এমভি-আল বাখেরা নামে সারবাহী একটি জাহাজে সাত খুনের ওই ঘটনা প্রকাশ পেলে সারা দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার কারণ বা সূত্র না পাওয়ায় এ নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। এর অন্যতম কারণ সারবাহী জাহাজটি থেকে কিছু খোয়া না যাওয়ায়। ওই ঘটনায় গুরুতর আহত জুয়েল নামে আরও একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় মামলা করেন জাহাজটির মালিক মাহাবুব মুর্শেদ। রাতেই র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১১ ও ৬ এর যৌথ অভিযানে বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আকাশকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গতকাল সন্ধ্যায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চাঁদপুর নৌ-পুলিশের পরিদর্শক কালাম খাঁ চাঁদপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আকাশ মন্ডলকে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে শুনানি শেষে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক মুহাম্মদ ফারহান সাদিক। এর আগে গতকাল দুপুরে কুমিল্লা নগরের শাকতলা এলাকায় আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জাহাজে সাত খুনের রহস্য তুলে ধরেন র্যাব-১১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর সাকিব হোসেন।
তিনি জানান, আকাশ জাহাজের মাস্টারের সঙ্গে বেতন ও খারাপ ব্যবহারে ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা ঘটান। তিনি তরকারির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অচেতন করেন। এরপর প্রথমে মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে খুন করেন। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বাকিদেরও হত্যার উদ্দেশ্যে কোপানো হয়। এতে আরও ছয়জন মারা যান। আকাশের কাছ থেকে একটি হ্যান্ড গ্লাভস, ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, খুন হওয়া ব্যক্তিদের ব্যবহৃত পাঁচটি ফোনসহ ৭টি মোবাইল ফোন ও রক্ত মাখানো একটি জিন্স প্যান্ট জব্দ করা হয়েছে। আকাশ বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার জগদীশ মন্ডলের ছেলে।
মেজর সাকিব হোসেন বলেন, আকাশ ছিলেন ওই জাহাজের সহায়ক। বাজার ও রান্নায় সহযোগিতা করতেন। জাহাজের বাজার করতে তিনি পাবনার একটি বাজারে নেমেছিলেন। সেখান থেকে তিনি তিন পাতা ঘুমের ওষুধ কেনেন। যে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে সবাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেটি আগেই জাহাজে ছিল। কুড়ালটি জাহাজের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছিল।
জানা যায়, ঘটনার দিন প্রথমে ওই জাহাজ থেকে পাঁচজনের লাশ এবং গুরুতর আহত অবস্থায় আরও তিনজনকে উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুজনের মৃত্যু হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মেজর সাকিব হোসেন জানিয়েছেন, আকাশ মন্ডল প্রায় আট মাস ধরে ওই জাহাজে চাকরি করছিলেন। কিন্তু জাহাজের কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময়মতো পেতেন না এবং বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার একাই ভোগ করতেন। জাহাজের মাস্টার সব কর্মচারীর ওপর বিনা কারণে রাগারাগি করতেন এবং কারোর ওপর নাখোশ হলে তাকে কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতেন, এমনকি তাদের বকেয়া বেতনও দিতেন না। এ ব্যাপারে তিনি জাহাজের সবাইকে প্রতিবাদ করতে বললে কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতেন না বলে আকাশ মন্ডল র্যাবকে জানিয়েছেন।
জাহাজের মাস্টারের কথিত এহেন কার্যকলাপের কারণেই আকাশের মাঝে প্রচ- ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং এ ক্ষোভ থেকে তাকে (মাস্টারকে) উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শুধু সুকানি জুয়েল এবং আকাশ মন্ডল ছাড়া সবাই রাতের খাবার খেয়ে তাদের কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে রাত আনুমানিক ২টায় সাহারা বিকন এলাকায় আরও আট-১০টি জাহাজের সঙ্গে তাদের জাহাজটি নোঙর করা হয়। পরবর্তীতে সুকানি জুয়েল রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আকাশ মন্ডল তার পরিকল্পনা মোতাবেক আনুমানিক রাত ৩টায় প্রথমে মাস্টারকে জাহাজে থাকা চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীতে চিন্তাভাবনা করেন যে- জাহাজে থাকা বাকিরা জেনে গেলে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়বেন। তাই একে একে সবাইকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে আনুমানিক ভোর ৫টায় সব জাহাজ তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলে আকাশ নিজেই জাহাজ চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে মাঝিরচর নামক এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়লে পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রলারে বাজার করার কথা বলে পালিয়ে যান। খুন হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী।
নড়াইলের দুজনের দাফন সম্পন্ন : এমভি আল-বাখেরা সারবাহী জাহাজে নিহত আমিনুর রহমান মুন্সীর লাশ লোহাগড়া উপজেলার ইতনা ইউনিয়নের উত্তর পাঙ্খারচর গ্রামে এবং সালাউদ্দিন ফকিরের লাশ একই উপজেলার লাহুড়িয়া ইউনিয়নের এগারোনলী গ্রামে মঙ্গলবার রাতে দাফন করা হয়।
খুব দ্রুতই চাঁদপুর হত্যা মামলার সুরাহা হবে -স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, চাঁদপুরের মেঘনায় বহুল আলোচিত সারবোঝাই কার্গো জাহাজে সাত খুনের ঘটনার দ্রুত সুরাহা হবে। গতকাল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উপাসনালয় রাজধানীর কাকরাইল সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রাল গির্জা পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, মর্মান্তিক ওই ঘটনায় যারা খুন হয়েছেন তাদের সবার মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের মোটিভ এখনো জানা যায়নি। তবে আটককৃত ব্যক্তি জবানবন্দি দিয়েছেন। খুব দ্রুত এই মামলার সুরাহা হবে বলে আমরা আশাবাদী। তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিউমার্কেট এলাকায় নিহত সবুজ ও শাজাহান হত্যা মামলায় চার্জশিট থেকে আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টায় জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ ১০৫