• ৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২৪শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ চায় সবাই

"আলোকিত সংবাদ ডেস্ক"
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪, ০১:৩৮ পূর্বাহ্ণ
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ চায় সবাই
সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল::পুলিশ সংস্কারে গঠিত কমিশনের কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি, পুলিশ বাহিনী ছাড়াও বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা নানা সুপারিশ দাখিল করেছে। এসব সুপারিশে সব পক্ষই পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার প্রস্তাব করেছে। সংস্কার কমিশনের জরিপেও গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে এই বিষয়টি। জরিপে ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অবসান চেয়েছেন। পাশাপাশি সংস্কার কমিশনে দাখিল করা বেশিরভাগ সুপারিশে পুলিশ বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বলপ্রয়োগে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বা নীতিমালা অনুসরণের প্রস্তাব এসেছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ প্রস্তাবেই পুলিশ কর্তৃক বেআইনিভাবে আটক, গ্রেপ্তারের অবসান চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে মানবাধিকারে গুরুত্ব দিতে পুলিশের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে প্রণীত আইন ও বিধিবিধান সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে সংস্কার কমিশনের কাছে যে প্রস্তাব করা হয়েছে- তাতে ঔপনিবেশিক আমলের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে জবাবদিহিমূলক জনমুখী পুলিশ বাহিনী গড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পুলিশ আইন, পিআরবিসহ অন্যান্য বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ ফোর্সের ব্যবস্থাপনা, গ্রেপ্তার, আটক, তল্লাশি, জব্দসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন গাইডলাইন প্রণয়নেরও প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি পুলিশকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেছেন, ব্রিটিশ আমলে গঠিত পুলিশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ব্রিটিশ শাসকদের শাসনকে পাকাপোক্ত করা। সেই আইনি কাঠামোতেই চলে আসছে বাংলাদেশ পুলিশ। ফলে বিগত সময়ে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান মোকাবিলায় পুলিশ জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এতে বাহিনীটি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ভবিষ্যতে পুলিশ আর জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না। আইনি কাঠামোর সংস্কার ছাড়া পুলিশের মৌলিক সমস্যা দূর করা সম্ভব নয় বলে মত পুলিশ কর্মকর্তাদের।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সংস্কার কমিশনের কাছে মোট ১৭ দফা প্রস্তাব দাখিল করে। সেখানেও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়তে এবং মানবাধিকারের প্রতি আরও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের অযৌক্তিক সহিংস বলপ্রয়োগ এবং নিষ্ঠুর আচরণের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ কর্তৃক বেআইনিভাবে আটক, গ্রেপ্তার, তুলে নিয়ে অস্বীকার করা, যতদিন খুশি আটক ও গুম করে রাখার ঘটনার অবসান ঘটাতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। অন্যদিকে, পুলিশ বাহিনীকে সঠিক দিক নির্দেশনা, পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতিকে চেয়ারম্যান করে একটি পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। কাদের নিয়ে এই পুলিশ কমিশন গঠিত হবে তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।

পুলিশ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মানবাধিকার ও শৃঙ্খলা রক্ষায় শক্তিপ্রয়োগ বিষয়ে আরও জোরালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিয়ন্ত্রণে শক্তিপ্রয়োগের ধারাবাহিকতার গাইডলাইন সঠিকভাবে শেখানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সর্বনিম্ন, সমানুপাতিক ও আইনসিদ্ধ শক্তিপ্রয়োগের বিষয়ে গুরুত্ব এবং মব সাইকোলজি বিষয়ক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে।

উন্নত বিশে^ ৮ ঘণ্টার বেশি সরকারি দায়িত্ব পালন করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে নিয়মমাফিক ওভারটাইম হিসেবে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তা পায় না। ৮ ঘণ্টার বেশি অতিরিক্ত ডিউটি করানো হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য যাতে আর্থিক সুবিধা পায় পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে এ বিষয়ে সুপারিশ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। বিষয়টি বিএনপির প্রস্তাবেও উঠে এসেছে।

‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক পুলিশ সংস্কার কমিশনের অনলাইন জনমত জরিপে মোট ২৪ হাজার ৪৪২ জন মতামত দেন। সেখানে সর্বাধিক মতামত আসে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তের পক্ষে। এরপরই আইনের প্রতি অনুগত, নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ গড়ার পক্ষে সর্বাধিক মতামত আসে। জরিপে গুম, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে চরম মানবিকতার লঙ্ঘন বিবেচনায় অপরাধী পুলিশকে জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দেন ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা। ভুয়া বা গায়েবি মামলার অপসংস্কৃতির সংস্কার চান শতকরা ৯৫ জন।

অনলাইন জরিপে বিক্ষোভ মিছিল মোকাবিলা ও বিরোধী দলমত দমনে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের শাস্তি চেয়েছেন ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ (প্রায়) উত্তরদাতা। অন্যদিকে, ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিস্থাপিত প্রমিত পদ্ধতি (এসওপি) অনুসরণকে প্রবিধানভুক্ত করার পক্ষে মত দেন। জরিপে পুলিশকে জবাবদিহি ও বিভিন্ন প্রভাবমুক্ত রাখতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা কমিশনের পক্ষে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা মত দেন।

এদিকে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কারে সহায়তার প্রস্তাব করা হয়েছে। তারা পুলিশ সংস্কার কমিশনসহ পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। সেসব বৈঠকেও তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। তারা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের ওপরও জোর দিয়েছেন। এ ছাড়া বলপ্রয়োগে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে।

পুলিশ সংস্কার কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের মৌলিক সংস্কারে কমিশন গঠনসহ বলপ্রয়োগে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণে সুপারিশ করবে। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে প্রণীত আইনের সংস্কারেরও সুপারিশ করবে।

পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেন, সরকারের কাছে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দিতে খসড়া লেখার কাজ চলছে। ‘জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ’ পুলিশ বাহিনী গড়তে নানা সুপারিশ থাকবে প্রতিবেদনে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে পুলিশ তৈরি হয়েছিল দমন-পীড়নের জন্য। সেই জায়গা থেকে পুলিশকে বের করে আনতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দল পুলিশকে ব্যক্তিগত লাঠিয়াল হিসেবে যাতে ব্যবহার করতে না পারে- আইনে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।